অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশিকলে একই খাদক বিভিন্ন স্তরে স্থান পেতে পারে। এভাবে বেশ কয়েকটি খাদ্যশিকল একত্রিত হয়ে একটি জালের মতো গঠন তৈরি করে। একে খাদ্যজাল বলে। স্থলজ ও জলজ উভয় পরিবেশের জন্য এই ঘটনা সত্য। পুকুরের বাস্তুতন্ত্রের নিচের উদাহরণটি থেকে এ বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে।
উপরের চিত্রে দেখা যায়, উৎপাদক শৈবাল জুপ্ল্যাংকটন এবং ছোট মাছকে সরাসরি খাদ্য সরবরাহ করে।
জুপ্ল্যাংকটনকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে ছোট এবং বড় মাছ উভয়ই। বড় মাছ আবার ছোট মাছকে খায়। বাজ পাখি ছোট মাছ এবং বড় মাছের একই প্রজাতির একটু ছোট সদস্যদের সহজেই খেতে পারে। এখানে পাঁচটি বিভিন্নভাবে বেশ কয়েকটি খাদ্যশিকল তৈরি করে। এভাবে যে খাদ্যজাল তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে এর চেয়েও জটিল খাদ্যজাল তৈরি হতে পরে।
উপরের খাদ্যজালে মোট পাঁচটি খাদ্যশিকল পাওয়া যায়।
(৪) শৈবাল► ছোট মাছ ►বাজ পাখি।
(৮) শৈবাল► জুপ্ল্যাংকটন ►বড় মাছ► বাজ পাখি।
(c) শৈবাল► ছোট মাছ ►বড় মাছ ►বাজ পাখি।
(d) শৈবাল ►জুপ্ল্যাংকটন► ছোট মাছ ►বড় মাছ► বাজ পাখি।
(e) শৈবাল ►জুপ্ল্যাংকটন► ছোট মাছ► বাজ পাখি
বনভূমির বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যজাল হতে পারে নিম্নরূপ:
একক কাজ কাজ: চিত্র 13.04 এ উল্লিখিত খাদ্যজালে যেসব খাদ্যশিকল আছে তা লেখ। |
বাস্তুতন্ত্রে পুষ্টিপ্রবাহ (Nutrient flow in ecosystems)
উদ্ভিদ অজৈব বস্তু গ্রহণ করে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার খাদ্য প্রস্তুত করে। উদ্ভিদ যে খাদ্য তৈরি করে, তার কিছু অংশ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করে, অবশিষ্টাংশ উদ্ভিদ দেহেই জমা থাকে। তৃণভোজী প্রাণী এসব উদ্ভিদ খায় এবং পর্যায়ক্রমে মাংসাশী প্রাণী এসব তৃণভোজীদের খায়। এসব উদ্ভিদ এবং প্রাণীদের মৃত্যুর পর বিয়োজকগুলো এদের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে অজৈব বস্তুতে রূপান্তরিত করে পরিবেশে ফিরিয়ে দেয়। সবুজ উদ্ভিদ এসব অজৈব বস্তু প্রহণ করে এবং পুনরায় খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহার করে থাকে। পুষ্টিদ্রব্যের এরূপ চক্রাকারে প্রবাহিত হওয়ার প্রক্রিয়াটিকে পুষ্টিপ্রবাহ বলে। খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এরূপ পুষ্টির প্রবাহ বাস্তুতন্ত্রের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
বাস্তুতন্যে শক্তির প্রবাহ (Energy flow in the ecosystem)
যেকোনো বাস্তুতন্ত্রের শক্তির মূল উৎস সূর্য। সূর্য থেকে যে পরিমাণ আলো এবং তাপশক্তি পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় তার বড়জোড় 2% সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে। বাস্তুতন্ত্রের পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য প্রাথমিকভাবে শর্করায় আলো ও তাপশক্তি রাসায়নিক শক্তি হিসেবে মজুত করে। বিভিন্ন প্রকার খাদ্যশিকলের মাধ্যমে উদ্ভিদে জমা হওয়া এই শক্তি বিভিন্ন খাদ্যস্তরে পৌঁছায়। শেষ পর্যন্ত বিয়োজকের কাজের ফলে সকল শক্তি আবার পরিবেশে ফিরে আসে।
তৃণভোজী প্রাণীরা অর্থাৎ বাস্তুতন্ত্রের প্রথম স্তরের খাদকেরা সবুজ উদ্ভিদের পাতা, কান্ড, ফুল, ফল, বীজ বা মূল খেয়ে জীবন ধারণ করে। এভাবে সবুজ উদ্ভিদে উৎপাদিত রাসায়নিক শক্তি প্রথমে তৃণভোজী প্রাণীতে পৌঁছায়। মাংসাশী প্রাণী যারা প্রথম স্তরের খাদকদের (তৃণভোজী প্রাণীদের) খেয়ে বাঁচে, তারাই দ্বিতীয় স্তরের খাদক। প্রথম স্তরের খাদক থেকে এভাবে রাসায়নিক শক্তি দ্বিতীয় স্তরের খাদকের দেহে স্থানান্তরিত হয়। একইভাবে দ্বিতীয় স্তরের খাদক থেকে রাসায়নিক শক্তি খাদ্য আকারে তৃতীয় স্তরের খাদকে পৌঁছায়। যদি তৃতীয় স্তরের খাদককে আরও উচ্চতর কোনো খাদক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তবে একই প্রক্রিয়ায় শন্তি সর্বোচ্চ স্তরের খাদকে পৌঁছায়।
মৃত্যুর পর সব জীবের শন্তি গ্রহণ প্রক্রিয়া থেমে যায়। তখন ঐ মৃতদেহে সঞ্চিত রাসায়নিক শক্তি বিয়োজকের কাজের ফলে ভেঙে জড় পদার্থ বা শক্তি আকারে আবার পরিবেশে ফিরে আসে। পরিবেশের বিভিন্ন জড় বস্তুর মধ্যে জমা হওয়া এই শক্তি তখন আবার উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হয়। আর এভাবে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে বাস্তুতন্ত্রে প্রাকৃতিক শক্তির প্রবাহ চলতে থাকে।
সব ধরনের খাদ্যশিকলেই প্রতিটি স্তরে কিছু অপচয় হয়। উৎপাদক সবুজ উদ্ভিদ থেকে তৃণভোজী প্রাণী যতটা শক্তি গ্রহণ করে, তার শরীরে ততটা শক্তি জমা হয় না। আবার দ্বিতীয় স্তরে খাদক তৃণভোজী প্রাণীর দেহ থেকে যে পরিমাণ পুষ্টিদ্রব্য গ্রহণ করে, তার নিজের দেহে সে পরিমাণ পুষ্টি পৌঁছায় না, কিছুটা জড় পরিবেশে মুক্ত হয়। এভাবে এক জীব থেকে আরেক জীবে খাদ্যশক্তি স্থানান্তরের সময় বেশ কিছু শক্তি বাস্তুতন্ত্রের সাধারণ নিয়মেই এই তন্ত্রের বাইরে চলে যায়। এ কারণে খাদ্যশিকলে খাদ্যস্তরের সংখ্যা যত কমানো যায়, শক্তির অপচয় তত কম হয়।
ট্রফিক লেভেলের মধ্যে শক্তির সম্পর্ক
খাদ্যশিকলের প্রতিটি স্তরকে ট্রফিক লেভেল বলে। সে হিসেবে উৎপাদক, প্রথম স্তরের খাদক, দ্বিতীয় স্তরের খাদক এবং চূড়ান্ত স্তরের খাদক প্রত্যেকেই এক একটি ট্রফিক লেভেল। বাস্তুতন্ত্রে উৎপাদক প্রথম বা সর্বনিম্ন ট্রফিক লেভেলের প্রতিনিধিত্ব করে। তৃণভোজী খাদক অর্থাৎ প্রথম স্তরের খাদক দ্বিতীয় ট্রফিক লেভেলের প্রতিনিধি। এভাবে নিম্ন স্তরের মাংসাশী প্রাণী তৃতীয় ট্রফিক লেভেল এবং উচ্চ পর্যায়ের মাংসাশী প্রাণী সর্বোচ্চ ট্রফিক লেভেলের প্রতিনিধিত্ব করে। কোনো খাদ্যশিকলের উৎপাদক বা সর্বনিম্ন ট্রফিক লেভেলে সূর্য থেকে যে শক্তি সংগৃহীত হয়, পরবর্তী প্রতিটি ট্রফিক লেভেলে তার কিছু অংশ তাপ হিসেবে বেরিয়ে যায়। এজন্য দেখা যায় যে উৎপাদক যে পরিমাণ শক্তি সূর্য থেকে সংগ্রহ করে তা দ্বিতীয় ট্রফিক লেভেলে এসে কমে যায়। তৃতীয় বা সর্বোচ্চ ট্রফিক লেভেলে এসে শক্তির পরিমাণ আরও কমে যায়। সাধারণত, যেকোনো বাস্তুতন্ত্রের কোনো একটি ট্রফিক লেভেলে যতটুকু শক্তি থাকে তার প্রায় 10% ঠিক উপরের ট্রফিক লেভেলে সঞ্চারিত হতে পারে। বাকি 90% তাপ হিসেবে পরিবেশে বিমুক্ত হয় কিংবা আংশিকভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়।
শক্তি পিরামিডের ধারণা
সমতল ভূমির উপর অবস্থিত যে ত্রিমাত্রিক বস্তুর শীর্ষদেশ ক্রমশ সরু, তাকে পিরামিড (pyramid) বলে। কোনো একটি বাস্তুতন্ত্রে ট্রফিক লেভেলের গঠন একটি পিরামিড আকারে দেখানো যায়। খাদ্যশিকলে যুক্ত প্রতিটি পুষ্টিস্তরের শক্তি সঞ্চয় ও স্থানান্তরের বিন্যাস ছককে শক্তি পিরামিড বলে। পিরামিডের সবচেয়ে নিচে উৎপাদক স্তরের শক্তির পরিমাণ পরবর্তী ট্রফিক লেভেলগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। উপরের ট্রফিক লেভেলের জীব নিচের ট্রফিক লেভেলের জীবদের চেয়ে শ্বসন এবং অন্যান্য কাজে ক্রমবর্ধমান হারে অধিক শক্তি তাপ হিসেবে হারায়। এজন্য উৎপাদক থাকে পিরামিডের ভূমিতে এবং চূড়ান্ত খাদক থাকে সবার উপরে।
খাদ্যশিকল সীমিত রাখতে শক্তি পিরামিডের প্রভাব
শক্তির এই প্রবাহ সব সময়েই একমুখী। এ শক্তিপ্রবাহকে কখনো বিপরীতমুখী করা যায় না। প্রতিটি ধাপে প্রায় 90% ভাগ শক্তি কমে যায় বা ব্যবহারযোগ্যতা হারায়। শক্তির এ ক্রমবর্ধমান ক্ষয় খাদ্যশিকলের আকারকে 4 বা 5টি ধাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখে। খাদ্যশিকল যত দীর্ঘ হবে, ঊর্ধ্বতম ট্রফিক লেভেলে শক্তির পরিমাণ ততই কমতে থাকবে এবং একপর্যায়ে এসে আর কোনো শক্তিই অবশিষ্ট থাকবে না।
common.read_more